“আমরা তো মরনের লেইগাই আইসি। আমরা গুলি খামু, মরমু এই লেইগাই আইসি। আমার ভাইদের মারল কেন? আমার ভাইদের জন্য আমি নিজেও মরতে পারি…”
শিহান বলছিল কথাগুলো।। যাত্রাবাড়িতে মুহুর্মুহু গুলি করে মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করার যে ভিডিওটা দেখে আমরা সবাই শিউরে উঠেছিলাম, সেখানকার সম্ভবত একমাত্র সারভাইভার শিহান।
বাসায় মিথ্যা বলে ভোলা থেকে ঢাকায় চলে এসেছিল ও। আন্দোলন করতে। কারণ জিগেস করায় কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সাইদ ভাইকে কতডি গুলি মারল, নিজের চোখে দেখা। আরো অনেক ভাইদেরকে মারল। মনে হইসে আমরা তো বেঁচে থেকে লাভ নাই, আমাদের জন্য তো ওরা আন্দোলন করে। আমি যদি ঘরে বইসা থাকি আমার ভাই যদি আমার জন্য আন্দোলন করে ঐটা কেমন?”
৫ তারিখ সকাল আটটায় সাইনবোর্ডের দিক থেকে প্রথম মিছিলটা আসে। শিহান আর ওর বন্ধু মিছিলে মিশে যায়। তারপর চলতে থাকে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া। মানুষের স্রোতের সাথে ওরাও ভেসে যাচ্ছিল এদিক থেকে সেদিকে।
দুপুর দুইটার দিকে যখন থানা থেকে গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসে পুলিশ বাহিনী তখন শিহান ওর বন্ধুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গুলি থেকে বাঁচতে পিলারের পেছনে আশ্রয় নেয়। ও বুঝতে পারে নি এরপর কী হতে চলেছে, বোঝার কথাও না, ভিডিওটা দেখে আমরাও কি কেউ বিশ্বাস করতে পেরেছিলাম?
শিহান প্রথম গুলিটা হাত দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করে। ওর সাইদ ভাইয়ের মতই।
গুলিতে ওর ডান হাতের মধ্যমা উড়ে যায়। ও বুঝতে পারে নি কিছু কারণ ঠিক পরের গুলিটাই ওর বুকে ঢোকে, লাং কলাপ্স করার ফলে ও শেষবারের মত একটা পরিপূর্ণ নিশ্বাস নিতে পারে। এরপর দম বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, পড়ে যায় ও।
জ্ঞান হারায় নি। চারপাশে কী হচ্ছে ঠিক ই দেখতে পাচ্ছিল। ওর ভাইরা ছটফট করে মারা যাচ্ছিল আর ও দেখছি
ল। ওর ভাষায়, “আমার পাশে বিশ-পঁচিশ জন মানুষ ছিল। আমার সামনে দিয়া মারা গেসে। আমার পরিস্থিতিটা কেমন ছিল সেই সময়। ছটফট ছটফট করে। রাস্তায় গড়াগড়ি করে। কেউ কেউ ভিডিও করতেসিল আমরা মারা যাইতেসি। কেউ তার আম্মুর সাথে ফোনে কথা বলসে। সবাই জানাইসে আমরা মরতেসি ভাইদের জন্য।”
জিগেস করি, “তোমার কাউকে ফোন দিতে ইচ্ছা করে নাই?”
ওর কান্নার তোড় আরেকটু বেড়ে যায়। বলে, “আমার ফোন দিতে ইচ্ছা করসে কিন্তু শ্বাসকষ্টের কারণে ফোনটা নিতে পারি নাই। আমার বারবার দেখতে ইচ্ছা করসে আমার মারে একটু। ফোন দিয়া একটু কন্ঠটা শুনি…”
প্রায় আধা ঘন্টা পর পুলিশরা সরে গেলে মানুষ এগিয়ে আসে ওদের কাছে। শুধু দুইজন তখনো নড়ছিল। শিহান আর ওর আরেক ভাই। ও ভাই ছাড়া আর কিছু বলে না ওর পাশের মানুষগুলোকে। ওদের দুইজনকে একটা রিকশায় তুলে কিছুদূর নিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর অন্য ভাইটা ইন্তেকাল করেন। রিকশাওয়ালা নাকি এত কাঁদছিলেন যে রাস্তা ভিজে যাবে মনে হচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতেই একজনের নিথর দেহ নামিয়ে রেখে আরেকজনকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেন তিনি।
তারপর অপারেশন, যন্ত্রণা, দিনের পর দিন দম নিতে না পারার কষ্ট… এখনো চলছে, চলবে আরো বহুদিন, আর ডিজ্যাবিলিটি তো সারাজীবন…
বাবা মায়ের এক মাত্র ছেলে ও। আর আছে দু’টো বোন। পড়ালেখা করে ‘একটা ভালো পর্যায়ে’ নেয়ার ইচ্ছা ছিল ওর পরিবারকে। কিন্তু… ওর ডান হাতের মধ্যমাটা তো উড়ে গেছে… ও এখন লিখবে কীভাবে?…
ও সব জেনে বুঝেই এসেছিল। শহীদ হওয়ার জন্যই। এত কিছুর পরও বলছে ওর কোনো আফসোস নাই। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ওর নাকি গুলি খেয়ে মরে গেলেও কোনো আফসোস থাকতো না।
শিহানের কাছে আরো অনেক কিছু জানার ছিল। জানার ছিল স্বাধীনতার মানে ওর কাছে কী। কিন্তু সাথে থাকা ডাক্তার বন্ধু বাপ্পী বলল ওর কষ্ট হচ্ছে, কাঁদলে আরো বেশি শ্বাসকষ্ট হবে, তাই কথাগুলো জমা রইলো ভবিষ্যতের জন্য।
ওর কথা শুনতে শুনতে কান্না সামলানোর চেষ্টা করছিলাম আর ভাবছিলাম যে ভাইদের ডাকে শিহানরা এভাবে সর্বস্ব দিয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দিল তারা তাদের দায়িত্বের পর্বতসম ওজন বুঝতে পারছে তো? পারতেই হবে কিন্তু!
আর ইমিডিয়েটলি, আমরা, ওদের ভাইরা সবাই যেন সবার আগে ওদের পাশে দাঁড়াই। কোনো শহীদ পরিবার যেন অর্থ কষ্টে না ভোগে, কোনো আহতের পরিবার যেন একটুও অসহায়ত্ব কিংবা সুচিকিৎসার অভাব বোধ না করে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। ওদেরকে ভুলে যাওয়া মানে নিজেদেরকে ভুলে যাওয়া, নিজেদের অস্তিত্বের মূলকে ভুলে যাওয়া। বারবার এই ভুল আমরা করেছি আগেও, এবার যেন না করি।
(গল্পগুলো শোনার অভিপ্রায় থেকে আহতদের কাছে গিয়েছিলাম। মনে রাখার স্বার্থে ভয়েস রেকর্ড করছিলাম যেন পরে লিখতে পারি। কিন্তু শিহানের কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার অজান্তেই বন্ধু Nazmush Shakib Bappi ভিডিও রেকর্ড করতে শুরু করে। ওর মাধ্যমেই শিহানকে খুঁজে পাওয়া।
গল্পটা লিখতে শুরু করার এক পর্যায়ে মনে হলো শিহানের অভিব্যক্তিগুলো পৃথিবীর কোনো ভাষার ধারণ করার ক্ষমতা নেই। তাই ভিডিও আর অডিওগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়ে দিচ্ছি সাথে। অডিওর শুরুর দিকে শিহানের সহযোদ্ধা বন্ধু ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করে, এরপর শিহান বলে বাকিটুকু।
শিহানের ডান হাতের মধ্যমা কখনোই ফিরে পাওয়া সম্ভব না। বুলেটের আঘাতে ফুসফুস কলাপ্স করেছে তাই এখনো ওর শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। ওর এক্স-রের ছবি গুলো কমেন্টে দিয়ে দিচ্ছি। এক্স-রেতে ওর নাম লেখা সিয়াম, কারণ ওকে যখন প্রথম হাসপাতালে আনা হয়েছিল তখন ওর নিজের নাম বলতেও খুব কষ্ট হচ্ছিল, ডিউটিতে যারা ছিলেন তারা শিহান কে সিয়াম নামেই লিপিবদ্ধ করেছেন…)
©️ Fahim Bin Faruque

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *