“সবাই আনন্দ উল্লাস করতেসেন, আমাদের তো কোনো আনন্দ নাই। রাস্তায় বের হইলে সবার মুখে হাসি দেখে অনেক কষ্ট লাগে। আমাদের বাসার কেউ কোনো মিষ্টি খায় নাই…”
শহীদ রাসেলের সদ্য বিধবা স্ত্রী মুক্তা আপা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলছিলেন কথাগুলো। পুরোটা সময় তিনি একটুও না কেঁদে, নিজেকে ধরে রেখে রাসেল ভাইয়ের গল্পগুলো বলেছেন, কিন্তু এখানে এসে আর পারলেন না।
১৬ জুলাই রাতে শহীদ আবু সাইদের চির স্মরণীয় আত্মত্যাগের ভিডিওটা রাসেল ভাইকে তিনিই দেখিয়েছিলেন। “দেখো ছেলেটাকে কীভাবে মেরে ফেলল”, এই বলে।
অন্যায় দেখলে নিজে কিছু করতে চাওয়ার মানসিকতাটা রাসেল ভাইয়ের নাকি সব সময় ই ছিল। ফিলিস৩ এর ভিডিওগুলো দেখতেন আর বলতেন যদি সু্যোগ থাকতো তাহলে সেখানে গিয়ে প্রতিরোধ করতেন, প্রয়োজনে শহীদ হয়ে যেতেন। আর তাই শহীদ আবু সাইদের ভিডিও আরো লাখো মানুষের মত রাসেল ভাইয়ের ভেতরটাও তোলপাড় করে দিয়েছিল। পরদিন থেকেই রাস্তায় নেমে একা একাই খুঁজতে শুরু করেন কোথায় আন্দোলন হচ্ছে, কীভাবে তিনি অংশ হতে পারেন।
আর এবারই যে প্রথম একা একা কোনো ‘ঝামেলার’ ভেতর ঢুকতে গিয়েছেন তিনি তাও না। একবার এক চোরকে গণপিটুনির হাত থেকে একাই বাঁচিয়ে হাতে তুলে দিয়েছিলেন পকেটে থাকা ৫০০ টাকার পুরোটাই। অনেক দিন পর কোন এক রেস্টুরেন্টে সেই মসজিদের দান বাক্স থেকে চুরি করতে গিয়ে মার খাওয়া ছেলেটাকে কাজ করতে দেখে অসীম তৃপ্তি নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন।
আরেকবার এক গরীব সহকর্মীর বাবা মারা যাওয়ার খবর শুনে মাসের বাজারের পাঁচ হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে চলে আসেন। বাসার মানুষ যখন বাজার কই, কী দিয়ে চলবে বলে তখন আবার বাকিতে ডিম আর চাল কিনে নিয়ে আসেন দোকান থেকে।
এরকম চিন্তা ভাবনা না করে দিয়ে দেয়ার স্বভাবের কারণে অভিযোগ করলে নাকি একটা কথাই বলতেন সব সময়, “আল্লাহ ব্যবস্থা করবে, মানুষকে দিলে আল্লাহ ই দেয়”।
শাহাদাত হয়তো এমন মানুষদের ভাগ্যেই জোটে।
১৮ তারিখ সংঘর্ষের তীব্রতা চোখের সামনে দেখেছেন। নাকে কাপড় বেঁধে টিয়ারশেল প্রতিরোধের খেলা শেষে ঘরে ফিরে খেলার ছলে স্ত্রী আর বোনকে বলছিলেন, শহীদ হয়ে গেলে তোমরা কী করবা? স্ত্রী বলেছিলেন, শহীদ হবেন ভাল কথা, আমাদেরকে কোথায় রেখে যাবেন আর কী দিয়ে যাবেন সেটা ভেবে হইয়েন। তিনি আর কথা বাড়ান নি, উত্তর ছিল না যে কোন।
রাতের বেলা ঘুমানোর সময় আবার স্ত্রীকে জিগেস করলেন, “আমি মরে গেলে তুমি কী করবা?” এই প্রশ্ন নাকি তিনি মাঝে মাঝেই করতেন, আর মুক্তা আপা মজা করে বলতেন, “বিয়ে করে ফেলব আর কী করব?” শুনে রাসেল ভাই কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে আক্রমণের ভঙ্গি করতেন। কিন্তু মৃত্যুর আগের রাতে একই উত্তর পেয়ে কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। আগে থেকেই বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা।
১৯ তারিখ ইন্টারনেট বন্ধ। বাসার সবাই বলছিল আজকে তো সব গুলি করে মেরে ফেলবে। রাসেল ভাইও সায় দিয়ে বলেছিলেন যে আজকে বের হবেন না। জানতেন বের হতে চাইলে রাজি হবে না কেউ। কিন্তু দুপুরের আগ দিয়ে যখন মুক্তা আপা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন নীরবে বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
খিলগাঁও থেকে সোজা রামপুরা পৌঁছে যান, জুমার নামাজ পড়েন, জীবনের শেষ নামাজ। নামাজ শেষে বের হয়ে বনশ্রীর দিক থেকে রামপুরার কাছাকাছি আসতেই বিজিবির একটা গুলি বুকের বাম পাশে ঢুকে গেল। নামাজের সঙ্গী যিনি ছিলেন তিনি আন্দোলনেও নাকি পাশেই ছিলেন, গুলিবিদ্ধ রাসেল ভাইকে নিয়ে দ্রুত ফরাজি হস্পিটালে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন তারা।
এদিকে মুক্তা আপার ফোনে কল আসে, কোনো একজনের ব্যাগে তার পার্লারের কার্ড পাওয়া গেছে, গুরুতর আহত, দ্রুত যেন হস্পিটালে পৌঁছান। নিশ্চিত হতে না পেরে রাসেল ভাইয়ের মোবাইলে কল করেন, রিসিভ করে সেই এক ই লোক… মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কোনো কিছুই পাচ্ছিলেন না, শেষে এক রিকশাওয়ালার রিকশা জড়ায়ে কান্নায় ভেঙে পড়ার পর রিকশাওয়ালা নিয়ে যেতে রাজি হয়।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখেন রাসেল ভাইয়ের মুখে তুলা ঢোকানো হচ্ছে তখন। আমাদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বলতে পারেন নি সেসময় তার মনে কী চলছিল, আমরাও সাহস করি নি জিগেস করার।
রাসেল ভাইয়ের নিথর দেহ ওনাদের কাছে বের করে দিয়ে মুগদা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলা হয়। একটা অটোরিকশায় করে মুগদা মেডিকেলে পৌঁছানোর পর শহীদ রাসেলের দেহ একটা স্ট্রেচারে করে এক কোনায় রেখে দেয়া হয়।
ময়নাতদন্তের অপেক্ষায় দুপুর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বসেছিলেন সবাই, কিন্তু রামপুরা থানা পুলিশের পক্ষে তখন আসা অসম্ভব। তাই ফুলে উঠতে শুরু করা লাশ নিয়ে রাসেল ভাইয়ের বাড়ি নরসিংদীর পথে রওনা দেন মুক্তা আপা ময়নাতদন্ত ছাড়াই। বিয়ের মাত্র তিন বছর হয়েছিলো, এখনো শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া হয় নি তার। রাসেল ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল বড় করে অনুষ্ঠান করে একবারে নিয়ে তুলবেন, বাড়িতে ঘর ও তুলছিলেন সে উদ্দেশ্যে তিনি।
পথে নাকি গাড়ি থামিয়েছিল ছাত্ররা। সব কিছু জানতে পেরে বলেছিল আপনাদের এক ছেলে শহীদ হয়েছে চাচী, চিন্তা করবেন না আমরা লক্ষ ছেলে আছি ইন শা আল্লাহ…
আমরা সে লক্ষ ছেলেদের একজন হয়েই গিয়েছিলাম আমাদের শহীদ ভাইয়ের ঘরে। শহীদের ভাইয়েরা কি কথা দিয়ে না রেখে পারে?
শহীদ রাসেল ভাইয়ের ঘরে আশি উর্ধ্ব বয়সী বাবা আছেন, বৃদ্ধা মা আছেন। দুই বোনের একজন বিবাহিত। আরেক বোন বিধবা, একটা মেয়ে আছে, ভাইয়ের ছায়ায় জীবন কাটিয়ে দিবেন বলে বিয়ে করেন নি আর। আর আছে সদ্য বিধবা স্ত্রী, বিয়ের তিন বছর হবে কিছুদিন পর।
বাবা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাটুকু তার মূল সম্বল এখন। স্ত্রীর জন্য ক’দিন আগেই একটা পার্লার দিয়েছিলেন, দু’জনের মিলিত আয়ে ভালো চলবেন সেই স্বপ্ন নিয়ে। পার্লার আর বাড়িতে ঘর তোলার জন্য ঋণ করেছিলেন বেশ কিছু, প্রায় পনের লাখ টাকার মত।
এখন অসহায় স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শহীদ স্বামীর ঋনের ভার নিজের কাঁধে নেয়ার। স্বপ্ন নিয়ে গোছানো নিজেদের বাসা ছেড়ে উঠেছেন পার্লারের ই একটা রুমে। হাতে দু’টো অপশন, সব কিছু বিক্রি করে লোনগুলো পরিশোধ করা কিংবা ব্যবসাটা একা একা চালিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করা। ভাবছেন কোনটা করবেন।
স্বামীর স্মৃতি, ঋণের বোঝা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে পথ চলতে গিয়ে তাই সবার আনন্দ দেখে তার বুক ভেঙে কান্না আসে। সবার মুখে হাসি দেখে তার অভিমান হয়। হওয়ার ই তো কথা, তাইনা?